করোনার প্রকোপ কমলেও এখনও তিন ধরনের জ্বরে কাবু বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাসিন্দারা। বাড়ছে চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু ও সাধারণ ভাইরাস জ্বরের (ফ্ল্রু) প্রকোপ। চট্টগ্রাম নগরী ও জেলার প্রতিটি এলাকায় রয়েছে এসব জ্বরে আক্রান্ত রোগী।
চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়া এ তিন ধরনের জ্বরের মধ্যে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এসব জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে উচ্চমাত্রার জ্বর, শরীরে তীব্র ব্যথা, কখনও ফুলে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। অনেক সময় জ্বর সেরে গেলেও কয়েক সপ্তাহ ধরে জয়েন্টের ব্যথা থেকে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আবুল ফয়সাল মো. নুরুদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন, এই মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস ছড়াচ্ছে, যেগুলোর উপসর্গ প্রায় একই। তবে অধিকাংশ রোগীই শেষ পর্যন্ত চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হচ্ছেন।
এদিকে, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে জ্বরে আক্রান্তদের ভিড় বাড়ছে। পাশাপাশি গিঁটে ব্যথা ও র্যাশে আক্রান্ত হয়ে কোনও কোনও পরিবারের একাধিক সদস্য চিকিৎসকের কাছে আসছেন। আতঙ্ক ছড়ালেও স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে নেই কার্যকর কোনও উদ্যোগ।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ব্যথানাশক ওষুধ বেশি খেলে ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই জ্বর হলে নিজে নিজে ওষুধ না খেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামে চলতি বছর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ২২৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১১৭ এবং নারী ১১০ জন। মারা গেছেন ৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫ এবং নারী ৪ জন।
চট্টগ্রামে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯৫২ জন। এর মধ্যে শিশু ১৫৮, পুরুষ ৫১৬ ও নারী ২৭৭ জন। মারা গেছেন ১৩ জন। মারা যাওয়াদের মধ্যে ৯ জন পুরুষ, ৩ জন নারী এবং একজন শিশু রয়েছে।
অপরদিকে, একই সময়ে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৩৪৩ জন। এর মধ্যে মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) একদিনে আক্রান্ত হন ১০১ জন।
নগরীর চকবাজার থানাধীন চন্দনপুরা এলাকার বাসিন্দা আবু হোসাইন খান বলেন, ‘আমি জ্বর এবং ব্যথা নিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ ঘরে বিশ্রামে ছিলাম। প্রথমে আমার জ্বর দেখা দেয়। এর পরপরই মাথাব্যথা, শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা শুরু হয়। পরে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হলে নেগেটিভ আসে। এরপর পরীক্ষা করে চিকুনগুনিয়া পজিটিভ আসে। জ্বর সেরে গেলেও এখনও শরীর দুর্বল এবং জয়েন্টে এখনও ব্যথা আছে।’
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া মশাবাহিত রোগ। এ রোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে মশা মারতে হবে এবং মশার কামড় থেকে বাঁচতে হবে। তবে নগরীর বাসিন্দাদের অভিযোগ, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগ বহুগুণ বাড়লেও ওষুধ ছিটাতে দেখা যায় না সিটি করপোরেশনের কর্মীদের। এদিকে, থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে দিনের পর দিন বিভিন্ন স্থানে জমে থাকছে পানি। এতে বাড়ছে মশার প্রজনন। এমন পরিস্থিতিতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ক্রাশ প্রোগ্রাম চলমান আছে। আগামী চার মাস নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত লার্ভিসাইড এবং বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ফগিং কার্যক্রম চলবে। মশার লার্ভা ধ্বংসে শিকাগো শহর থেকে আনা বিটিআই নামক ওষুধও প্রয়োগ করা হবে।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে ওষুধ ছিটানোর জন্য সিটি করপোরেশনে ২১০ জন কর্মী আছেন। তারা নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে কাজ করছেন। এর মধ্যে বড় ওয়ার্ডগুলোতে ৭ জন এবং ছোট ওয়ার্ডগুলোতে ৫ জন কর্মরত আছেন। এর বাইরে ৭২ জন সদস্য নিয়ে ছয়টি স্পেশাল টিম গঠন করা হয়েছে। এই টিমগুলো ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হচ্ছে এমন এলাকায় নিয়মিত ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম পরিচালনা করছে।’
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এইচএম হামিদুল্লাহ মেহেদী বলেন, ‘আমাদের কাছে যে পরিমাণ জ্বরের রোগী আসছে, তার প্রায় ৮০ শতাংশেরই চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ রয়েছে। পরীক্ষার খরচ বেশি হওয়ায় অনেকে ল্যাবে যাচ্ছেন না। তাই লক্ষণ বিবেচনায়ই চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। হাসপাতাল ও ব্যক্তিগত চেম্বারে এখন ডেঙ্গুর চেয়ে চিকুনগুনিয়ার রোগীই বেশি।’
এ প্রসঙ্গে সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটে অবস্থিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি)-এর অধ্যাপক ডা. মো. মামুনুর রশীদ বলেন, ‘বর্তমানে নানা ধরনের জ্বরে ভুগছেন চট্টগ্রামের মানুষ। যার মধ্যে রয়েছে– চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু ও সাধারণ ভাইরাস জ্বর (ফ্লু)। গত কয়েক দিন ধরে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমেছে। এবার ডেঙ্গু রোগীর পাশাপাশি চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে। তবে হাসপাতালে বেশি ভর্তি হচ্ছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া মশাবাহিত রোগ। এ রোগ থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই মশা নিধন করতে হবে। অর্থাৎ মশার কামড় থেকে বাঁচতে হবে।’
সিভিল সার্জন ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগীর পাশাপাশি চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে। এ জন্য সচেতনতা প্রয়োজন। নগরী ও জেলায় সচেতনতার জন্য লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে।’
তিনি জানান, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ব্যথানাশক ওষুধ বেশি খেলে ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই জ্বর হলে নিজে নিজে ওষুধ না খেয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।