রংপুরের তারাগঞ্জে দলিত সম্প্রদায়ের (মুচি) রূপলাল দাস ও তার ভাগ্নি জামাই প্রদীপ দাসকে মব করে গণপিটুনি দেওয়ার খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এলেও তাদের রক্ষা করার কোনও পদক্ষেপ না নিয়ে চলে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে দায়িত্ব অবহেলার জন্য দুই এসআই সহ আট পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
তারা হলেন- তারাগঞ্জ থানার এসআই আবু জোবায়ের, এসআই শফিকুল ইসলাম, কনস্টেবল ফারিকুদ আখতার জামান, বিরাজ কুমার রায়, হাসান আলী, ফিরোজ কবীর, মোক্তার হোসেন ও বাবুল চন্দ্র রায়।
পুলিশ জানায়, ওই দুই এসআই ও ছয় কনস্টেবল মোবাইল টিমের সদস্য ছিলেন। সেই সঙ্গে ঘটনা তদন্ত করার জন্য রংপুর তারাগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বুধবার (১৩ আগস্ট) রাত পৌনে ১০টার সময় রংপুরের পুলিশ সুপার আবু সাইম বিষয়টি এ প্রতিনিধিকে নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, এ ঘটনায় পুলিশ কী দায়িত্ব পালন করেছে তা জানতে তদন্ত কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ওই ঘটনায় করা মামলার তদন্ত কারী কর্মকর্তা এসআই আবু জোবায়রকে তদন্তের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে তারাগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) রফিকুল ইসলামকে নতুন তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে তারাগঞ্জ থানার ওসি এম এ ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কোনও মন্তব্য না করে বলেন, এসপি স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
এদিকে এ সংক্রান্ত পাঁচ মিনিট ২১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেটিতে দেখা গেছে, পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও তাদের উদ্ধার করারও কোনও উদ্যোগ নেয়নি।
ভিডিওতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বলতে দেখা গেছে, রূপলাল ও প্রদীপ দাসকে যখন গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছিল খবর পেয়ে তারাগঞ্জ থানা থেকে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসার পরও দুজনই বেঁচে ছিলেন। এমনকি তাদের যখন বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আনা হয় তখনও পুলিশ তৎপর হলে তাদের উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পারতো- ফলে দুজনই প্রাণে বাঁচতে পারতেন।
ভিডিওতে দেখা গেছে, তারাগঞ্জ থানার ওসি স্বীকার করেছেন খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলেও ২/৩ হাজার জনতাকে সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি। তারা তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন- এমন কথা বলতে পারেননি। ফলে এ ক্ষেত্রে পুলিশ তাদের দায় এড়াতে পারে না বলে নিহত রূপ লালের স্বজনরা অভিযোগ করেছেন।
আরও দেখা যায়, রূপলাল দাস ও প্রদীপ দাসকে যখন আটক করে বুড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে একটি ভ্যানের ওপর বসিয়ে রাখা হয়েছে। চারদিকে কয়েকশ মানুষ, পুলিশের চার সদস্য ভ্যানটি ঘিরে বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছিলেন এবং হাত তুলে জনতাকে নিবৃত করার চেষ্টা করছেন। এ সময় রূপ লালকে ভ্যানের ওপর দাঁড়িয়ে সবার কাছে জীবন ভিক্ষা করার জন্য হাত জোড় করতে দেখা যায়। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে ভ্যানের মধ্যেই তার পরনের খুলে যাওয়া লুঙ্গি ঠিক করতে দেখা যায়।
পুলিশ জনতাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও মব সৃষ্টি করা মানুষেরা আরও উত্তেজিত হয়ে চিল্লাচিল্লি শুরু করলে পুলিশ গণপিটুনিতে গুরুতর আহতদের ফেলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে চলে যায়।
এ বিষয়ে রূপ লালের মামা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুলিশ দেখলো তারা মাত্র চার জন, ঘটনা সামাল দিতে পারছে না। বিষয়টি থানার ওসিকে কল করে জানালে আরও ফোর্স নিয়ে এলে হয়তোবা রূপলাল ও প্রবীর দাসকে জীবিত উদ্ধার করতে পারতো। কারণ পুলিশ আসা, অবস্থান করা ও চলে যাওয়ার এক ঘণ্টা পরও তারা দুজনই জীবিত ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী আরও এক যুবক নাম প্রকাশ না করে বলেন, রূপলাল দাস ও তার ভাগ্নি জামাই প্রদীপ দাস ভ্যানে করে যখন আসছিলেন, তখন আল আমিন নামে এক ব্যক্তি প্রথমে ভ্যানটি আটকিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছিল। এ সময় বস্তার মধ্যে কী আছে তা জানতে চায়। এ সময় মেহেদী হাসান নামে এক যুবক সেখানে এসে বস্তার ভেতরে ছোট ছোট বোতলে তাড়ি (দেশি মদ) দেখতে পেয়ে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় হইচই শুরু হলে মেহেদী হাসান এই বলে জনতাকে খেপিয়ে তুলতে বলে, ‘এই সব খাইয়ে ওরা ভ্যান ছিনতাই করার চেষ্টা করছিল’।
ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশ চলে যাওয়ার পর রূপলাল মাথা তুলতেই কালো গেঞ্জি পরা এক যুবক তাকে ঘুষি মারেন। এতে আবার লুটিয়ে পড়েন রূপলাল। এরপর ভ্যানের ওপর শোয়া অবস্থায় থাকা দুজনকে কয়েকজন ব্যক্তি যে যেভাবে পারেন কিল, ঘুষি, লাথি, লাঠি ও রড দিয়ে মারতে থাকে। একপর্যায়ে ভ্যানের ওপর থেকে মাটিতে পড়ে যান প্রদীপ দাস। এ দৃশ্য মোবাইল ফোনের আলো জ্বালিয়ে অনেকেই ভিডিও করছিলেন। প্রদীপ দাস ভ্যান থেকে মাটিতে পড়ে গেলে তাকে অনবরত লাথি মারতে দেখা যায়।
একপর্যায়ে কয়েকজন রূপলাল ও প্রদীপকে রশি, জুতা, গাছের ডাল, ভ্যানের প্যাডেল দিয়ে মারধর করতে থাকে। এ সময় দুজনই জ্ঞান হারিয়ে গোঙাতে থাকেন। এ সময় মৃত্যু নিশ্চিত করতে হলুদ, কালো, লাল গেঞ্জি পরা ৪/৫ জন রূপলালের পিঠে লাথি মারতে থাকে। হলুদ গেঞ্জি পরা দুই তরুণ দুই পা দিয়ে পিঠ বরাবর একাধিকবার লাথি দিতে থাকে- তারা উল্লাস করতে থাকে। এ সময় হলুদ গেঞ্জি পরা এক তরুণ গাছের ডাল দিয়ে আবারও দুজনকে মারতে থাকে। ছাই রঙয়ের গেঞ্জি পরা এক যুবক রূপলালের মৃত্যু নিশ্চিত করতে বার বার গলায় পা তুলে দেয়। আশপাশের কয়েকজন তখন বলছিল, ‘পুলিশ পালাইছে’।
এ বিষয়ে একজন স্কুল শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে বলেন, মব তৈরিকারীরা যেমন দোষী তেমনি পুলিশও তাদের দায় এড়াতে পারে না। কেননা ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে তাদের রক্ষা না করে উল্টো তারা নিজেরাই ঘটনাস্থল ত্যাগ করে চলে গেছে।
নিহত রূপলালের ছেলে জানান, তার বাবা ভাগ্নি জামাই প্রদীপকে তার বড় বোন নুপুরের বিয়ের জন্য আসতে বলেছেন। তিনি নিজের ভ্যান চালিয়ে আসছিলেন। অনেক দিন পর আসছিলেন বলে রাস্তা চিনতে ভুল করেছিলেন। এরপর রূপ লালকে কল করলে তিনি সেখানে গিয়ে দুজনে আসছিলেন। আর ব্যাগের ভেতরে থাকা তাড়ি (বাংলা মদ) তাদের সমাজে চলে, ফলে তাদের মব তৈরি করে চোর অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে তারাগঞ্জ থানার ওসি এম এ ফারুক বলেন, ঘটনাস্থলে হাজার হাজার মানুষ ছিলেন। এর বিপরীতে সেখানে চার জন পুলিশ সদস্য ছিলেন। তারা রূপলাল ও প্রদীপকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পেছন থেকে যখন পুলিশকে ধাক্কাধাক্কি, ঘুষাঘুষি শুরু করা হলে তখন তারা জীবনের ভয়ে সরে এসেছেন। পুলিশের করার কিছু ছিল না। এখন আমরা ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখে প্রকৃত দোষীদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।
উল্লেখ্য, গত ৯ আগস্ট শনিবার রাতে মুচি সম্প্রদায়ের রূপলাল ও তার ভাগ্নি জামাই প্রদীপকে চোরের অপবাদ দিয়ে মব তৈরি করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় রূপ লালের স্ত্রী ভারতী রানী বাদী হয়ে ৫০০/৭০০ অজ্ঞাতের বিরুদ্ধে তারাগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা করেছেন। পুলিশ এ পর্যন্ত চার জনকে গ্রেফতার করেছে।

















